প্রকাশিত: Thu, Feb 16, 2023 10:56 AM
আপডেট: Fri, Jun 27, 2025 2:05 AM

একজন মানুষ যদি ক্রমাগত ইতিহাসবোধশূন্য হতে থাকে, এর ফল কী হবে?

ফাহাম আবদুস সালাম : একজন মানুষ যদি ক্রমাগত ইতিহাসবোধশূন্য হতে থাকে, এর ফল কী হবে? এটা একটা তৃতীয় বিশ্বের রিসেন্ট ফেনোমেনন, যা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারি নাই। আমরা ছোটোবেলায় ক্যাডেট কলেজে ক্রস কান্ট্রি রেসে কলেজের বাইরে যেতাম। মানে কলেজের বাইরে ময়নামতি বৌদ্ধ বিহারের পেছনে গ্রামের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চক্কর দিয়ে ফিরে আসতাম। গুগল স্ট্রীট ভিউ দিয়ে জায়গাগুলো দেখছিলাম। ওই জায়গাগুলো এতোটাই বদলে গেছে যে আমি আর কিছুই চিনতে পারি না। কলেজে আমরা যে হাউজে থাকতাম সেটা ভেঙে ফেলা হচ্ছে ও নতুন হাউজ বানানো হয়েছে। আমি ওল্ড ডিওএইচএসে শিশু বয়স কাটিয়েছি। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন ৬ নম্বর রোডে ডানদিকে দ্বিতীয় বাড়িটা কেমন, আমি এখনো বলতে পারবো (হলুদ রঙের এক তলা বাড়ি)। কিন্তু সেই বাড়িগুলো একটাও এখন নাই। পুরা ওল্ড ডিওএইচএসে সম্ভবত জেনারেল ওসমানীর বাসা ছাড়া আর ২টা বাড়ি আছে যেগুলো অক্ষত। সব বাড়ি ভেঙে এপার্টমেন্ট বানানো হয়েছে। এসব হয়েছে মাত্র ৩০-৩৫ বছরের ভেতরে। ওল্ড ডিওএইচএসে সম্ভবত বাড়ি বানানো শুরু হয় ৭৫ এর দিকে। ৮৯‘র মধ্যে সব প্লটে বাসা হয়ে গিয়েছিলো এবং ২০১০ এর ভেতরেই ভাঙচুর কমপ্লিট এবং দ্বিতীয়বার ডেভেলাপমেন্ট। পুরা ঢাকা শহরেই এই একই অবস্থা। আমি এখন একটা ৫০ বছরের পুরোনো পাড়ার ৫০ বছরের পুরোনো বাসায় থাকি। আমার বাসা থেকে ১০ মিটার দূরে একটা পার্ক। সেই পার্কে বছর তিনেক আগে একদিন মেয়েকে নিয়ে গেছি। এক মা তার ছেলেকে নিয়ে এসেছেন।

 কথায় কথায় জানলাম যে তিনি ঠিক আমার বয়সী এবং এই পাড়াতেই তার জন্ম। আমার মেয়ে যে দোলনায় খেলছিলো ঠিক একই দোলনায় তিনি নিজে শিশুবেলায় চড়েছিলেন, বললেন আমাকে। চিন্তা করেন তো এই মহিলার যে ংবহংব ড়ভ নবষড়হমরহমহবংং- সেটা কি আমার কোনোদিন হবে? ভিয়েতনাম, চায়না, ইন্ডিয়ার বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছি। বহু মানুষ তাদের নিজের শহরে আর যেতেই চান না। কারণ তারা নিজের শহর আর চিনতে পারেন না। ‘হোম’ তাদের কাছে অন্য মানুষের স্মৃতি যেটা তারাও শেয়ার করেন। এই ব্যাপারটা সব কালেই ছিলো, কিন্তু আমাদের কালে তৃতীয় বিশ্বের বড়ো শহরগুলোতে যা হয়েছে তার মাত্রা অবিশ্বাস্য। এক জীবনে এই ধরনের পরিবর্তন কোনো মানুষের পক্ষে ইন্টারনালাইজ করা অসম্ভব বলে আমার মনে হয়। আমাদের জেনারেশন যখন রিটায়ারমেন্টে যাবে, ঢাকায় থেকেও তারা ঢাকা থেকে পুরাপুরি ডিসপ্লেইসড হয়ে যাবে। এটা একটা অদ্ভুত ফেনোমেনন যেটা আমরা এই সময়ে ঠাওর করতে পারছি না। আমাদের ছোটোবেলার কোনো ভিজুয়াল মেমোরিই আর অক্ষত থাকবে না। এই এলিয়েনেশান যে কী ভয়ঙ্কর সেটা বলে বোঝানো কঠিন। বনানী রেলগেটের পাশে একটা ছোটো স্টেশান ছিলো লাল রঙের। বলতে পারেন একটা ছোটো ওয়েইটিং রুম।

সেই স্টেশানের সিড়িতে বসে আমার গৃহ শিক্ষক মামুন স্যার মাঝে মাঝে বাদাম খাওয়াতেন। আমি তার কাছে জানতে চাইতাম, বগুড়া ঢাকা থেকে ঠিক কতো ছোটো ৮৮-৮৯‘র কথা। ওই ছোট্ট স্টেশনটা বহু আগেই নাই হয়ে গেছে। ২০১০-১১ সালের দিকে প্রথম দেখি যে স্টেশনটা আর নাই। এই বেদনা ব্যাখ্যা করা কঠিন তাই সে চেষ্টা না করি। ঠিক ৩০ বছর আগে উত্তরা ডালাসে একটা টঙের দোকানে বসে আমরা সিগ্রেট খেতাম আর ঢাকা শহরের মেয়েদের নিয়ে গুরুগম্ভীর গবেষণা করতাম। পুরা ল্যান্ডস্কেপই নাই হয়ে গেছে, গুগল স্ট্রীটভিউতে দেখলাম। জায়গাটা আর চেনারই উপায় নাই। ৮০‘র দশকে আমরা বাড়ীতে যা করতাম -আমাদের যে ওয়ে অফ লাইফ ছিলো। একমাত্র স্কুলে যাওয়া, ভাত (তরকারি না) আর নামাজ আগের মতো আছে। বাকি সবকিছু বদলে গেছে। এভরিথিং। ওয়েস্টে কিন্তু এই ঘটনাটা ঘটে নাই। আমি বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। এদের ওয়ে অফ লাইফ এইরকম ড্রাস্টিকলি বদলায় নাই। এই যে আমাদেরটা এভাবে বদলালো এর ফলাফল কী হবে। এই এলিয়েনেশান, এই ইরেজার কিন্তু গবেষণার বিষয়। আমার মনে হয় যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে ...তন্ত্র সহজেই শেকড় গাড়ছে এর একটা বড় কারণ হোলো মানুষ তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলছে। ফলে সে কিছুই আর রক্ষা করতে চায় না। অন্যের সময়, অন্যের শহর, অন্যের স্মৃতিকে ডিফেন্ড করতে হলে যে ত্যাগের প্রয়োজন হবে সেই ত্যাগকে সে স্যাক্রিফাইস মনে করতে অপারগ। ফেসবুক থেকে